কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম
করোনাকে সহঅবস্থানে রেখে কিভাবে আমাদের জীবন-জীবিকা অব্যাহত রাখা যায় সে ব্যাপারে ভাবতে হবে। বাঁচতে হলে খেতে হবে এর যেমন বিকল্প নেই, ঠিক তেমনি চালই হচ্ছে ভেতো বাঙালির খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম নিয়ামক। আদিকাল থেকে গোলায় ধান থাকলে বাঙালি নিজেকে নিরাপদ অনুভব করে, এটাই আমাদের স্বভাব জাত বৈশিষ্ট্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৩২ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন। চলতি বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ফলন বেশ আশানুরূপ ও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাস বলছে বিশ্বে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে টপকে একধাপ এগিয়ে চীন ও ভারতের পর পরই তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসবে। করোনা পরিস্থিতি কত দিন দীর্ঘায়িত হবে তা অনেক সমীকরণে ফেলেও অনুমান করা যাচ্ছে না। ফলে চালের অধিক উৎপাদন দেখে উচ্ছ¡সিত না হয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে চালের ব্যবহারে আমাদের আরও কৌশলী ও মিতব্যয়ী হতে হবে। তাই ভাতের ওপর চাপ কমিয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ বিকল্প খাদ্যাভ্যাসে নজর দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর এক ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘খাদ্য শুধু চাল, আটা নয়; মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, তরিতরকারিও আছে।’ বঙ্গবন্ধুর এ কথা থেকে উপলব্ধি করা যায় তিনি পুষ্টিনির্ভর জাতি বিনির্মাণে মনোযোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুসরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উৎসারিত কৃষিবান্ধব নীতি কৌশল এবং কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, এমপি’র জ্ঞান-সাধনায় শুধু খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা নয় বরং পুষ্টি নির্ভর মেধাবী জাতি গঠনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ভিটামিন ও মিনারেলের প্রধান উৎস মৌসুমি ফল একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে আম, কাঁঠাল, আনারস ও লিচু এর মধ্যে অন্যতম।
ফলের রাজা (ঞযব করহম ড়ভ ঋৎঁরঃং) আমই হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। এ ফল শিশু, বালক-বালিকা, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সকলের কাছে অতি প্রিয় একটি ফল। এ বছর প্রায় ১ লক্ষ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে এবং সাম্প্রতিক আমফানের প্রভাবে উৎপাদন কিছুটা কমে গেলেও সম্ভাব্য উৎপাদন প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে আম উৎপাদনে সপ্তম বাংলাদেশ। বর্তমানে প্রায় ২০টি অধিক জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হচ্ছে। ভরা মৌসুমে সারা দেশে দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার মেট্রিক টন আম বেচাকেনা হয়ে থাকে।
আমের পরেই উৎপাদনের দিক থেকে যে ফলটি অধিক উৎপাদিত হয় সেটি হলো বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। ভারতের কাঁঠাল বিশ্বে ঝঁঢ়বৎ ভড়ড়ফ নামে আর শ্রীলঙ্কায় কাঁঠাল ধান বৃক্ষ (জরপব ঃৎবব) হিসেবে সুপরিচিত। এ বছর বাংলাদেশে ৭১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল চাষ হয়েছে এবং সম্ভাব্য উৎপাদন ১৮ লক্ষ ৮৯ হাজার মেট্রিক টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কাঁচা কাঁঠাল বিশ^ বাজারে সবজি মাংস বা ঠবমবঃধনষব সবধঃ হিসেবে পরিচিত। কোষ ও আঁটি পরিপূর্ণ হলে অর্থাৎ পরিপক্ব ফল চিপ্স করার উপযোগী বা অন্যান্য তরকারির সাথে রান্না করা যায়। পাকা ফলের কোষ সরাসরি খাওয়া হয়। আবার পাকা ফলের কোষ বা পাল্প থেকে ক্যান্ডি, ফ্লেক্স, হালুয়াসহ রকমারি খাবার তৈরি করা যায়।
অ¤øমধুর স্বাদ ও সাধারণ সর্দি বা কাশিতে পথ্য হিসেবে যে ফলটি ধনী-গরিব সকলের কাছে বেশ সমাদৃত তা হলো আনারস। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সফল প্রয়োগের ফলে অসময়ে আনারস পাওয়া গেলেও সিংহভাগ বাজারে আসে মে-জুলাই মাসে। এ বছর আনারস চাষ হয়েছে ২০ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে এবং সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৪ লক্ষ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। আনারস একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল।
বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র এদেশে ফল-ফসল উৎপাদনে ধারাবাহিক ঈর্ষণীয় সাফল্য বা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখে আগামী দিনগুলোতে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না বরং যৌক্তিক খাদ্য গ্রহণ করোনা সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আলোর পথ দেখাবে।
শুধু তো খাবার খেলেই চলবে না করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোধে রোগ প্রতিরোধী খাবার খেতে হবে। প্রতি ১০০ গ্রাম সিদ্ধ চাল, আম, কাঁঠাল, আনারস ও লিচুর তুলনামূলক খাদ্যমান তুলনা করলে দেখা যায় চালে খাদ্যশক্তি ৩৪৯ কিলোক্যালরি এবং ভিটামিন বা মিনারেল নেই বললেই চলে। সেখানে পাকা আমে খাদ্যশক্তি ৮০ কিলোক্যালরি, ভিটামিন এ ৬০০ আইইউ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ টহরঃ) ও ভিটামিন সি ১৬ মিলিগ্রাম (কাঁচা আমে ৩ গুণ বেশি) পাওয়া যায়। পাকা কাঁঠালে খাদ্যশক্তি ৯৮ কিলোক্যালরি (কাঁঠালের বীজ বা আঁটিতে খাদ্যশক্তির পরিমাণ ১৩৯ কিলোক্যালরি), ভিটামিন এ ৫৪০ আইইউ ও ভিটামিন সি ১০ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। পাকা আনারসে খাদ্যশক্তি ৮৭ কিলোক্যালরি, ভিটামিন এ ৫ আইইউ ও ভিটামিন সি ৩৪ মিলিগ্রাম পাওয়া যায় এবং লিচুতে খাদ্যশক্তি ৬০ কিলোক্যালরি ও ভিটামিন সি ১১ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় মোটাদাগে বলা হয়ে থাকে একক উৎস থেকে অধিক খাদ্যশক্তিসম্পন্ন খাবার কম খাওয়াই উত্তম। পরামর্শ দেয়া হচ্ছে করোনা প্রতিরোধে ঘন ঘন পানি পানসহ ভিটামিন সি যুক্ত ফল খেতে হবে। বেশির ভাগ ফলেই শতকরা ৮০ ভাগ পানি থাকে। ভিটামিন-মিনারেলসমৃদ্ধ এসব ফল মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পুষ্টিবিদের মতে রাতে ঘুমানোর আগে নিয়মিত পাকা আম-লিচু খেলে ঘুম ভালো হয়, মানসিক প্রশান্তি বা স্বস্তিবোধও বাড়িয়ে দেয়। যাহোক, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের হিসাব মিলাতে অঙ্ক কষে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন খাবারটি কেন এবং কী পরিমাণে খেতে হবে।
ঐড়ঁংবযড়ষফ ওহপড়সব ্ ঊীঢ়বহফরঃঁৎব ঝঁৎাবু (ঐওঊঝ), ২০১৬ মতে বাংলাদেশে দৈনিক একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ মাথাপিছু ২২০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ করে থাকে এবং দৈনিক মাথাপিছু চাল বা দানাদার খাদ্য গ্রহণের মাত্রা প্রায় ৪০৬ গ্রাম। সে হিসেবে শুধু চাল থেকে ১৪১৫ কিলোক্যলরি খাদ্যশক্তি এবং অন্যান্য খাদ্য উৎস হতে বাকিটা পূরণ হচ্ছে। যদিও শরীর সুস্থ-সবল রাখতে ৩৫০ গ্রাম চাল খেলেই যথেষ্ট। একই সাথে বর্তমান সংযত ও নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে শারীরিক পরিশ্রমের হার অনেক কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকের তুলনায় তিন-চতুর্থাংশ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ যথেষ্ট বলে ধরে নেয়া যায়। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের প্রতিদিন ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার থাকলেও আমরা খাচ্ছি মাত্র ৮০ গ্রামেরও কম। তিন মাস যদি জনপ্রতি দৈনিক ২০০ গ্রাম বা তার অধিক ফলাহার করি এবং সমপরিমাণ ভাত কম গ্রহণ করি তাহলে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন চাল বাঁচান সম্ভব। তিন মাস হিসেব করলে চালের মজুদের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৯ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা দিয়ে সাড়ে ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীকে অতিরিক্ত দেড় মাসের অধিককাল অনায়াসে খাওয়ানো যাবে। দরকার শুধু সচেতনতা, কার্যকর পরিকল্পনা ও সঠিক উদ্যোগ।
পুষ্টিগুণ না জানা, নানাবিধ ব্যবহারের অজ্ঞতা এবং সর্বোপরি সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের সিংহভাগ নষ্ট হয়। ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার বাজারে ক্যানজাত আনারস সিরাপের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের উদ্বৃত্ত আনারস ক্যানজাত করে বা ¯øাইস করে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু কিছু কোম্পানি এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাগণ ফলের জুস, চকোলেট, পানীয়, আচার, চাটনি, ম্যাঙ্গোবার, আমচুর ইত্যাদি উৎপাদন ও বাজারজাত করে মূল্য সংযোজন করছে। আবার দেশে এমন কোন বিশেষায়িত হিমাগার গড়ে উঠেনি যে অধিক সময় সংরক্ষণ করে মৌসুমি ফল বেশি দিন খাওয়ানো যাবে। বিকল্প একটিই আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হবে, ভাত কম খেতে হবে এবং বেশি বেশি করে ফলের নানাবিধ ব্যবহার বাড়াতে হবে।
আসন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই যে তা খাবার কেনার সামর্থ্যে রূপ নেবে এমন নিশ্চয়তা কিন্তু কেউ দিতে পারবে না। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি সরকারের উচ্চ মহল এ বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্তসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে আমের জন্য একটি বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে ঢাকা স্বল্পমূল্যে আম পরিবহনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রান্তিক কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং ভোক্তারা যাতে তাদের চাহিদা মতো কৃষিপণ্য পেতে পারে সেজন্য বাংলাদেশের সর্বপ্রথম উন্মুক্ত কৃষি মার্কেটপ্লেস ‘ফুড ফর ন্যাশন’ চালু করেছে। আমাদের দেশে ডাক বিভাগ ‘কৃষকবন্ধু ডাক সেবা’ চালু করেছে যার মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদিত শাকসবজি-ফলমূল বিনামাশুলে পরিবহন করে ঢাকার বিভিন্ন বাজার ও সুপারশপে পৌঁছে দিচ্ছে। উদ্যোগ গ্রহণই শেষকথা নয় বরং উদ্যোগের আওতাভুক্ত সকল অংশীজনের কার্যকর অংশগ্রহণই কেবলমাত্র এ সমস্ত উদ্যোগের কাক্সিক্ষত সফলতা বয়ে আনতে পারে। য়
অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রেষণে পিএইচডি গবেষক, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর। মোবাইল-০১৭১৯৫৪৭১৭৯, ই-মেইল : sayemdae@yahoo.com